মেঘলা ও মেঘনা যমজ বোন। সবে মাত্র কলেজে ঢুকেছে ; এক তারিখ থেকে ক্লাস শুরু। গল্পের একটা শুরু থাকা দরকার তাই এভাবে শুরু করা গেল।
গল্পটা পচিঁশ বছর পিছনে নিয়ে গেলে গল্পটার শুরু ঝকঝকে এক তরুন ইঞ্জিনিয়ার মিথুন তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আর্তিকে নিয়ে; যদিও মূল গল্পটার মোহনায় আরও দু’জন আছে।
বিবাহোত্তর দশ বছরেও যখন তাদের সংসারে কোন সন্তানাদি এল না ; তখন তাদের জীবন ধীরে ধীরে দুঃসহ হয়ে উঠতে শুরু করল। কলিগদের মুখ টেপাটেপি দেখেও না দেখার ভান করে থাকে মিথুন। অনেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বাচ্চাদের গল্প বলে। কেউ কেউ ইঙ্গিতে ইঞ্জিনের খবর বলে। তখন মিথুনের বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। কষ্টে বুক বাঁধে। কেউ কেউ দত্তক নিতে বলে ‘আজকাল তো দত্তক পাওয়া তেমন কঠিন নয়; হাসপাতালে পরিচয়হীন অনেক সন্তান পাওয়া যায়।’ মিথুন নীরব।
দত্তকের বিষয়টিতে আর্তি নারাজ; কোন মতেই তাকে রাজি করান যায়নি।
আজকাল বাসাতেও মিথুন তেমন স্বস্তি পায় না যদিও আর্তি কোনদিন কোন অভিযোগ বা অনুযোগ কিছুই করেনি; তবু মিথুনের বুকের কোথায় যেন একটু চিন্ করে উঠে আর্তি সামনে এলে।
আগে ছুটির দিনগুলোতে আর্তিকে নিয়ে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেত; ইদানিং আর তেমন যাওয়া হয়না অবশ্য আর্তিরও তেমন আগ্রহ নেই।
উদসীনতা মিথুনকে ঘুণ পোকার মতো কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে ; কখনও কখনও মাঝ রাতে জানালা খোলে বাইরে তাকিয়ে থাকে ; হয়তো কখনও বৃষ্টির সাটে ভিজে যাচ্ছে কিন্তু কোন খেয়াল নেই সেদিকে।
মেঘে ঢাকা চাঁদ যেমন আলো ছায়ায় খেলে , ঠিক তেমনি আর্তির মুখের উপর আলোছায়ার খেলা প্রতিনিয়ত।
সন্তান যে শুধু বংশের বাতি তা নয়; মানব-মানবীর অনাবিল শান্তির সেতু বন্ধনও।
ডাক্তারি সর্ব-প্রকার চেষ্টায় ব্যর্থ; কবিরাজী তুকতাক শেষ। গ্রামে বেদের দল এসেছে; তখন কি একটা কাজে আর্তি গ্রামে এসেছে। কথার নানা ছলনার মধ্য দিয়ে আর্তির মনের রোগ ধরে ফেলে বেদেনি; কানে কানে শলপরামর্শ দেয়। আর্তিও সায় দেয় বেদেনির কথায়। মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন তুচ্ছ জিনিষকেও আকড়িয়ে ধরতে চায়; আর্তিও হয়তো তাই চেয়েছে। বেদেনি গাছের একটি শিকড় বেঁধে দেয় আর্তির হাতে; আর দেয় গাছ-গাছরার তৈরি কাঠ বড়ি।
উল্ল্যেখযোগ্য পয়ামটি হল তিন দিন দু’জনকে এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে; আর ভেজা চুলে বেঁধে দিতে হবে কদমের ফুল।
ৃআর্তির কথা শুনে ইঞ্জিনিয়ার মিথুন তো হেসেই খুন। সে আর্তিকে নানা ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করে। মিথুন যতোটা বোঝায় আর্তি ততোটাই ভিতরে ফোলে। কখনো সখনো আর্তির মুখের গুমট দেখে মনে হয় এই বুঝি ঝড় এল; অগত্যা মিথুন পরাভব মানে আর্তির ঝড়ো মেঘের কাছে।
সমস্যা হল পর পর তিন দিন বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। পর পর তিন দিন যদি বৃষ্টি না থাকে , পর পর তিন দিন না হয় বৃষ্টি থাকল তখন তারা কদম ফুল কোথায় পাবে ? এমনি করে কেটে গেল দু’বছর। ‘সাত মণ ঘিও জোটে না রাধেও আর নাচে না।’
আর্তি যখন টের পেল যে সে সন্তান সম্ভবা, মিথুন প্রথমে থতমথো খেয়ে যায়, পরে স্বাভাবিক হয়ে আর্তির নাকটা আলতো করে চেপে দিয়ে নাচতে থাকে। নতুন ভাবে শুরু হয় আর্তি ও মিথুনের খুনসুটি।
ভুলেই গিয়েছিল সব কথা, সহসা মিথুনের মনে পড়ে বৃষ্টিতে ভেজা ও কদম ফুলের কথা।
-দুই- গত শ্রাবণে মিথুন বদলি হয়ে এসেছে । নতুন স্থান নতুন আবহাওয়া ভালই লাগছে মিথুনের। আজ আর্তিকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে এসেছে ।
কদম তলার বেঞ্চটিতে বসে আছে দু’জন নর-নারী, পেছন দিক থেকে চেনা যাচ্ছে না; তবে মিথুনের বুকটা কেন যেন একবার ধরাস করে উঠল। উ..উ..উ ওকে তো রিতির মতই মনে হচ্ছে।
আর্তির সাথে গল্প করতে করতে এক সময় ওরা রিতির সামনে এসে পড়ে । দু’জনে চোখাচোখি হতেই একে অপরকে চিনে ফেলে । মিথুন ভাবে ও হয়তো রিতির বর,আর রিতি ভাবে ও হয়তো মিথুনের স্ত্রী। দু’জনের মনে তখন উথাল কল্লোল কিন্তু চেহারায় শেষ বিকেলের শান্ততা। রিতির পাশে বসা ছেলেটির হাতে ছিল কদম ফুল যা কিনা রিতির প্রিয়। ততক্ষণে রিতি উঠে দাড়িয়েছে,ছেলেটির হাত থেকে ফুলটি নিয়ে খোঁপায় গুঁজে চলতে শুরু করেছে। যথাস্থানে বসল গিয়ে আর্তি ও মিথুন। একজনের শুরু আর একজনের শেষ হলেও ঝড় শুরু হল রিতি ও মিথুনের মনের আকাশে ; কোন কথা না বললেও শ্রোতের তোড়ে ভেঙে পড়ছে মনের পাড়।
পরদিন অফিস থেকে এসেই মিথুন বলে ‘ চলো বেড়িয়ে আসি।’ আর্তি অবাক। আজকের এ বেড়াতে আসা আর্তি তাতে কিছুটা তাজ্জবও বনে যায়। অফিস থেকে এসেই নাওয়া নেই খাওয়া নেই ; অফিসের ড্রেস চেঞ্জ না করেই এভাবে কেন? আর্তির মনে খানিকটা খটকা লাগে।
আর্তিকে সঙ্গে আনলেও পার্কে এসে আর্তি ও মিথুনের মধ্যে যেন একটা বিকর্ষণ কাজ করছে, এটা আর্তির তীক্ষ্ণ মননে ধরা পরে। যেন কাছে থেকেও কাছে নেই,আর্তি ভাবে। ইতোমধ্যেই শিয়াল বৃষ্টিতে ভিজে লুতুপুতু। ‘তোমার কি হয়েছে বলো তো?’ আর্তি বলে। ‘কই’ মিথুনের তড়িঘড়ি উত্তর। তারপর দু’জনেই ভিজতে ভিজতে পার্ক থেকে বেরোয়।
দ্বিতীয় দিনেও একই অবস্থা। তৃতীয় দিনে আজ তারা পার্কে এসেছে । আজ আর্তির মনে বিদ্রোহের আভাস। আর্তি মনে মনে ঠিক করে আজ মিথুনের সাথে সে কোন কথাই বলবে না।
দু’জনে এসে বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে; দু’জনেই নীরব; অথচ দু’জনের পেটে হাজার কথার ভীড়। একজন মত্ত সসীমে. অন্যজন মত্ত অসীমে;একজনে উত্তর মেঘের সমারোহ অন্যজনে পূর্ব মেঘের ছড়াছড়ি। একজন কিরণে দাহিত অন্যজন বিকিরণে নিঃশেষ।
দু’জনে ভিজে জবুথবু হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কারও কোন খেয়াল নেই সেদিকে। দু’একটি কাক এদিক ওদিক ভিজে ভিজে উড়ছে। দু’একটি রসিক চোখ ও আনাগুনা করে দুর থেকে ; কেউবা মুখ টিপে হাসে।
বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। মিথুন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ‘রিতি আসছে একটি নীলাম্বরি শাড়ি পরে ; ওর পছন্দের শাড়ি ওটা। সারা শরীরে ভেজা শাড়ি লেপ্টে আছে, হাতে কদম ফুল; এসেই ফুলটি তার হাতে দেয়। আর সে আলগোছে ফুলটি তার খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছে।
বিজলীর ঝলকানিতে সে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখে সে আর্তির খোঁপায় একটি কদম ফুলৈ গুঁজে দিচ্ছে আর আর্তি আনমনে বসে আছে।
-তিন- মেঘনা ও মেঘলা বেঞ্চির দু’মাথায় দু’দিকে মুখ করে বসে আছে মাঝখানে পিয়াল ভিজছে যেন দাঁড়কাক। বর্ষারও যেন আজ কোন কাজ নেই অঝর ধারার বরিষণ। দৃশ্যটি কেমন যেন খাপ ছাড়া,তবুও এটাই সত্যি।
মেঘনা ও মেঘলা আর্তি-মিথুন দম্পতির যমজ সন্তান। তবে তাদের মধ্যে কোথাও এক চিমটি ফারাক নেই। বুদ্ধি মেধা ও শারীরিক গঠনেও অবিকল এক।
এস এস সি-তে দু’জনে হুবহু একই নম্বর পেয়েছে যা কিনা রীতি মতো অবাক কান্ড। আরও অবাকের বিষয় প্রতিটি সাবজেক্টেই হুবহু একই নম্বও পেয়েছে তারা । যমজদের নিয়ে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও মেঘনা ও মেঘলার মধ্যে মিলটা অতি মানবীয় । যখন মেঘনা বলে খিদে পেয়েছে তখন মেঘলাও বলে খিদে পেয়েছে; যখন মেঘনা বলে ঘুম পেয়েছে তখন মেঘলাও বলে ঘুম পেয়েছে। তাদের এই দ্বৈততা পরীক্ষার ফলাফলেও আর্জন করেছে তাতে সবাই মুগ্ধ।
দ’জনে একই কলেজে একই অনুষদে চান্স পেয়েছে। ঐ অনুসদেই প্রথম পরিচয় পিয়ালের সাথে। প্রথম দেখাতেই মেঘনার ভাল লেগে যায় পিয়ালকে। মেঘনা যখন পিয়ালকে নিয়ে ভাবে মেঘলাও তখন কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ে ; হৃদয়ের কোথায় যেন শূণ্যতা অনুভব করে , পিয়ালের কাছে ছুটে যেতে মন চায়।
পিয়াল মেঘনাকেই ভালবাসে কিন্তু তাদের শারীরিক নিটুলতা মাঝে মাঝে তাকে বিপাকে ফেলে দেয়। পিয়াল তাই মেঘনার বা হাতে চিমটি কেটে একটি দাগ করে দিয়েছে।
আজকাল মেঘনা ও মেঘলার মধ্যে খুব একটা ভাব দেখা যায় না। কি যেন একটা বিকর্ষণ কাজ করে । তাদের হাসি যেন চুপসে গেছে।
হাসি খুশি না থাকলেও কোন এক অদৃশ্য টানে তারা পরস্পরে এক লক্ষ্যে ঘনীভূত যখন পিয়ালকে কাছে পায়। ইদানিং বিষয়টা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে পিয়াল। পিয়ার ভাবনায় পড়ে যায়।
বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্য আজ পিয়াল মেঘনাকে নিয়ে পার্কে আসে ।
পিয়ালই প্রথম উত্থাপন করে বিষয়টা, প্রথম দিকে মেঘনা নাকচ করলেও পিয়ালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের কাছে হার মানে মেঘনা।
সহসা পিয়াল নিজেকে আবিস্কার করে সে দু’জনের মাঝখানে বসে আছে অর্থাৎ বেঞ্চের এক প্রান্তে মেঘনা আর অন্য প্রান্তে মেঘলা। মেঘলা কখন যে এসেছে খেয়াল করেনি।
পিয়াল বিদ্যুৎ পিষ্টের মত নিথর হয়ে পড়ে; কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে বলতে পারে না। পুলিশের লোক এসে যখন পিয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে তখন সে দেখে অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, তিনটি প্রানি ভিজছে তো ভিজছেই; নীরব নিশ্চুপ দু’জনের মাঝখানে সে বসে আছে।
আর্তি ও মিথুন মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়. তারা জানেনা তাদের এ বৃষ্টিতে ভেজার শেষ কোথায়!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
প্রিয় পাঠক,
বিপদে মানুষ কুসংস্কারে নর্ভরশীল হয়ে পড়ে,গল্পে আর্তি চরিত্রটিও সন্তান লাভের আশায় বেদেনির কথায় তিনদিন বৃষ্টিতে ভিজতে রাজি হয়; আবার মানুষের অজান্তেই কুসংস্কারটি জীবনে প্রতিফলিত হলে সেটা ভেবে মনে তৃপ্তি পায়,যেমনটা সন্তান লাভের পর বৃষ্টিতে ভেজার কথা আর্তির মনে পড়েছে। কিন্তু মেঘনা ও মেঘলার যে বৃষ্টি ভেজার ইতিহাস, এর সমীকরণ মেলাতে পারছেনা আর্তি। সে জানে না এর শেষ কোথায়। এভাবেই বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য। ধন্যবাদ।
১৯ মার্চ - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৫৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।